লাইসেন্স বিহীন ভাটায় নৈরাজ্যের মহোৎসব, প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি
জুবায়ের খান প্রিন্স, পাবনা :
পাবনার বিভিন্ন উপজেলায় ইটভাটাগুলো যেন আইনের বাইরে আলাদা এক ‘প্রভাবশালী সাম্রাজ্য’। প্রকাশ্যেই চলছে গাছ কাটার ভারী মেশিন, রাতদিন নির্বিচারে পোড়ানো হচ্ছে সবুজ বৃক্ষ। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কাঁচা কাঠ, কৃষিজমির উর্বর মাটি, এমনকি নানা নিষিদ্ধ জ্বালানি। আইন আছে—কিন্তু বাস্তবে নেই কোনো প্রয়োগ। আর এই সুযোগেই পরিবেশ ধ্বংসের উন্মুক্ত উৎসব চলছে জেলায়।
লাইসেন্স নেই, ছাড়পত্র নেই—তবু দেদারসে জ্বলছে আগুন
সরকারের নীতিমালায় ইটভাটা পরিচালনায় পরিবেশ ছাড়পত্র, ভূমি ব্যবহারের অনুমোদন, সাইট নির্বাচন, প্রযুক্তি নির্ধারণ—সবই বাধ্যতামূলক। কিন্তু সরেজমিনে পাবনা সদর উপজেলার চরভগিরাতপুর ঘুরে দেখা যায়—
বেশিরভাগ ভাটার লাইসেন্স নেই,
যাদের আছে তাদের নবায়ন বহু বছর হয়নি,
পরিবেশ ছাড়পত্রহীন ভাটা প্রায় শতভাগ,
নদীতীর, কৃষিজমি ও জনবসতির পাশেই স্থাপিত ভাটা।
স্থানীয়রা জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানা ভাটা মালিকদের কাছে “তুচ্ছ চাঁদা”র মতো—কয়েক দিনের মধ্যেই ফের জ্বলে ওঠে ভাটার আগুন।
সমিতির নামে চাপ, সিন্ডিকেটের নামে বাজার নিয়ন্ত্রণ অবৈধ কার্যক্রমকে বহাল রাখার জন্য কিছু ভাটা মালিক ‘সমিতি’ গঠন করে প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
অভিযোগ রয়েছে—
কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ইটের দাম বাড়ানো,
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ,
প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় অবৈধ ভাটা সচল রাখা।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, ঠিকাদার ও নিম্নআয়ের পরিবার।
সবুজ অদৃশ্য হচ্ছে!
ভাটার চারপাশে স্তূপ করা কাটা কাঠই বলে দেয়—এলাকাজুড়ে প্রতিদিন কত গাছ অদৃশ্য হচ্ছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে—
ফসলি জমির উর্বর মাটি কেটে নেওয়ায় কৃষিজমি নষ্ট,
ধোঁয়া ও ছাইয়ে নষ্ট হচ্ছে সবজি, আমন-রোপা ধান,
শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, চোখের জ্বালা বেড়ে যাওয়া।
পরিবেশবিদদের মতে, বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস ইটভাটার কালো ধোঁয়া।
একটি জাতীয় প্রতিবেদনে উল্লেখ—
দেশে কাগজে কলমে প্রায় ৮,৫০০ ইটভাটা, এর অর্ধেকেরই নেই কোনো বৈধ কাগজপত্র।
পার্শ্ববর্তী জেলা কুষ্টিয়াতে ২১৩ ভাটার মধ্যে ১৯৬টি অবৈধ।
পাবনায় চিত্রও প্রায় একই—অধিকাংশ ভাটাই অবৈধ।
উচ্ছেদের পরও ফের চালু হয়—প্রভাবশালীদের আশীর্বাদে অনেক ভাটা উচ্ছেদ করা হলেও কয়েক দিনের মধ্যেই ফের চালু হয় স্থানীয় প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সহায়তায়।
এটি দেখায়—এ শুধু পাবনার সমস্যা নয়, বরং দেশের ইটভাটা খাতে এক সিস্টেমেটিক নৈরাজ্য।
প্রশাসনের নীরবতা প্রশ্নের মুখে
সরকার ঘোষণা দিয়েছে—
নতুন ভাটার ছাড়পত্র দেওয়া হবে না,
অনুমোদনহীন ভাটা বন্ধ করতে হবে।
কিন্তু জেলা পর্যায়ে এ নীতির বাস্তবায়ন দুর্লভ।
স্থানীয়দের অভিযোগ—
“জরিমানা করে যায়, কয়েক দিনের মধ্যেই ভাটা আবার আগের মতো চালু হয়। মনিটরিং নেই। সমিতির ব্যানার দেখিয়ে মালিকরা চাপ সৃষ্টি করে।”
ভাটা মালিকদের বক্তব্য: ‘আমরা বৈধভাবে চলতে চাই’
কয়েকজন ভাটা মালিকের দাবি—
কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ থাকে,
হাজারো শ্রমিক নির্ভরশীল,
লাইসেন্স ও পরিবেশ ছাড়পত্র করেও হয়রানির শিকার।
তাদের ভাষায়— “যাদের লাইসেন্স নেই তারা আরও সুবিধা নিয়ে ভাটা চালাচ্ছে। তাহলে সরকারি নীতিমালা কোথায়? এজন্যই সবাইকে ম্যানেজ করেই ব্যবসা চলছে। আমরা বৈধভাবে করতে চাই, এটা তো কোনো অপরাধের ব্যবসা নয়।”
সমাধান জরুরি, দাবি জনসাধারণের, সাধারণ মানুষ এখন কার্যকর পদক্ষেপ চায়—
অবৈধ ভাটা সম্পূর্ণ উচ্ছেদ,
পরিবেশবান্ধব ব্লক ইটকে বাধ্যতামূলক করা,
কৃষিজমি সুরক্ষায় মনিটরিং টিম,
গাছ পোড়ানো বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ,
বছরে নয়—নিয়মিত মনিটরিং কার্যক্রম,
পরিবেশ রক্ষা ও নিয়মনীতি মেনে ব্যবসার নিশ্চয়তা—এটাই এখন সময়ের দাবি।
এ বিষয়ে পরিবেশ কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বললে তারা জানায় আমরা নিয়মিত মনিটরিং অব্যহত রেখেছি। জরিমানা করছি, চিমনি ভাঙছি তবুও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। শিঘ্রই মন্ত্রনালয়ের নির্দেশমত কার্যকর ভুমিকা নেবো।
0 Comments