Header Ads Widget

Responsive Advertisement

ফ্রিডম ফ্লোটিলার দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় ভিন্নমাত্রা

 


ড. মো. মনছুর আলম  

ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন বা এফএফসি হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, চিকিৎসক, ত্রাণকর্মী নিয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। ‘ফ্লোটিলা’ স্প্যানিস শব্দ; যার শাব্দিক অর্থ নৌবহর। আরবি ‘সুমুদ’ অর্থ ‘অটলতা বা অবিচল সহনশীলতা’ যা ফ্লোটিলা’র পারিভাষিক রূপ বলা যেতে পারে। ফ্রিডম ফ্লোটিলা’র মূল লক্ষ্য হলো ইসরাইলি অবরোধ ভেঙে দেওয়া এবং ফিলিস্তিনির মানবিক সংকটের প্রতি বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করা। উদ্দেশ্য একধিক থাকলেও মূল উদ্দেশ্য গাজা ছিটমহলে ত্রাণ সামগ্রী অর্থাৎ মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়া। ফ্লোটিলা কোয়ালিশন মানবিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০১০ সাল থেকে গাজায় একধিক মিশন সংগঠিত করেছে। তাদের মিশন নিয়ে এবছর বিশ্বব্যাপী হৈ চৈ পড়ার মূল কারণ হলো তাদের উদ্দেশ্যে যুক্ত হয়েছে ভিন্নমাত্রা। আর তা হলো, গাজায় জাতিগত নিধন ঠেকাতে বিশ্ব নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা ও কপট ভূমিকার মূলে কুঠারাঘাত করা। তাই এ অভিযাত্রার চেতনায় যুক্ত হয়েছে ‘থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজা (টিএমটিজি)’; হাজারো জাহাজের প্রতীকী ধারণা এটি। ইসরাইলি সেনা কর্তৃক একটি জাহাজ আটক বা বাধাপ্রাপ্ত হলে অন্য জাহাজ এগিয়ে যাবে, সেটি বাধাপ্রাপ্ত হলে অপর জাহাজ অন্য পথ ধরে এগিয়ে যাবে। এভাবে তারা অবরোধ ভাঙতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

এই নৌবহরটি ২০২৫ সালের আগস্ট-সেপ্টম্বর মাসের মধ্যে যাত্রা শুরু করে। ৩১ আগস্ট  জেনোয়া থেকে, ৩১ আগস্ট বার্সেলোনা থেকে এবং ৭ সেপ্টম্বর তিউনিস ও কাতানিয়া থেকে কনভয় রওনা হয়। বাংলাদেশ থেকে অংশ নেওয়া একমাত্র সদস্য প্রখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী ও লেখক ড. শহিদুল আলম ইতালির অতরান্তো থেকে সবচেয়ে দ্রুতগামী এবং তুলনামূলক বড়ো জাহাজ ‘কনশানস’-এ উঠেছেন। কনশানস ইটালি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর রওনা দেয় গাজা অভিমুখে। ড. শহিদুল আলম গাজাগামী এই দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় যোগ দেওয়ায় বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেছে। যাত্রা শুরু থেকে বলতে গেলে, তিনি প্রতিদিন প্রায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন। ড. শহিদুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “থাউজেন্ড ম্যাডলিনস একটি অবিস্মরণীয় ধারণা। জাতিগত নিধন ঠেকাতে বিশ্ব নেতাদের পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়তা এবং কপট ভূমিকার কারণে বিশ্বের জনগণ নিজেরাই পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হাজরো জাহাজের ধারণাটি প্রতীকী।” শুক্রবার লিখেছেন, তিনি যে নৌযানে অবস্থান করছেন সেই কনশানস বহরের সবচেয়ে বড়ো নৌযান। এটি সবার শেষে ইতালি থেকে যাত্রা শুরু করলেও গতি বেশি হওয়ায় বাকিদের ছুঁয়ে ফেলতে সময় নেয়নি। এখন কনশানসের গতি কমানো হয়েছে এবং সব নৌযান গাজার দিকে একযোগে এগিয়ে যাচ্ছে। শনিবার দুপুরে তিনি তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, আমরা কনশানসের মানুষেরা অবরোধ ভাঙতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা যদি আমাদের আটকায়, অন্যরা এগিয়ে আসবে। দমনপীড়নকারী কখনোই জনগণের শক্তির বিরুদ্ধে টিকতে পারেনি। ইসরায়েলও ব্যর্থ হবে। তিনি শেষবার একটি ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন যে, তারা ফিলিস্তিনি টাইম জোনে ঢুকে পড়েছেন। অর্থাৎ রবিবার ৫ অক্টোবর দুপুর সাড়ে ১২টার সর্বশেষ একটি পোস্ট দেন সেখানে বলেন, ট্রাকার ব্যবহার করে তাদের অনুসরণ করা হচ্ছে। কনশানস ও থাউজেন্ড ম্যাডলিনস উভয় নৌবহবেরর যাত্রাপথ ট্র্যাক করছে ইসরাইলি বাহিনী। এরপর থেকে আজ অবধি তাঁর কোন পোস্ট বা খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি। বর্তমানে তিনি ঠিক কোথায় আছেন বা তার নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এদিকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তার অবস্থান ও নিরাপত্তা নিবিরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানা যায়। (সুত্র: প্রথম আলো)।

সূত্র হতে জানা যায়, এবারের এই দুঃসাহসিক নৌযাত্রায় যোগ দিয়েছে বিশ্বের কয়েকটি জোট। এর মধ্যে রয়েছে ‘গ্লোবাল মুভমেন্ট টু গাজা’, ‘মাগরেব সুমুদ ফ্লোটিলা’, ‘সুমুদ নুসান্তারা’ এবং ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন বা এপএপসি। সব মিলিয়ে কমবেশি অর্ধশত জাহাজে পাঁচ শতাধিক যাত্রী গাজা অভিমুখে রওনা দিয়েছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাত থেকেই সেগুলোতে হামলা ও নাশকতা চালাতে থাকে ইসরায়েলি বাহিনী। এসব জাহাজ থেকে সাড়ে চারশ’র বেশি যাত্রীকে আটক করে নিয়ে যায়; তাদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বব্যাপী পরিচিত সুইডিশ অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গও রয়েছেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সময়ে আরও পাঁচবার ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ ইউরোপ থেকে গাজার পথে ভূমধ্যসাগর পারি দিলেও প্রথম ফ্রিডম ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ৯ জন নিহত হন। বর্তমান অভিযাত্রা সমন্ধে বিশ্ব সংবাদমাধ্যম যেমন খবর রাখছে তেমনি জাহাজ ট্র্যাকার অ্যাপসেও নজর রাখছে কোটি কোটি মানুষ। রয়টার্স লিখেছে, ‘গত ১০ দিনে এটা ইসরায়েলি অবরোধের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চতম প্রতিপক্ষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সামাজিক মাধ্যমে চৌকস প্রচারণা, হালনাগাদ নৌযান শনাক্তকরণ প্রযুক্তি, লাগসই ওয়েব নকশা এবং তৃণমূল সাংগঠনিক তৎপরতা এবারের অভিযানকে ব্যাপক মনোযোগ ও সমর্থন এনে দিয়েছে; গাজা অবরোধ তুলে নিতে বৈশ্বিক আন্দোলন জোরদার করেছে’ (৪ অক্টোবর ২০২৫)।

এদিকে ফ্রিডম ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার ইতালিজুড়ে সাধারণ ধর্মঘট ছাড়াও প্যারিস, লন্ডন, বার্লিন, জেনেভা, ডাবলিন, ইস্তাম্বুল, বার্সেলোনার মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে, বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। ইউরোপের বাইরে আর্জেন্টিনা, মেক্সিকোতে বিক্ষোভ হয়েছে। কলম্বিয়ায় বিক্ষোভ ছাড়াও দেশটি ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে। রয়টার্স বলছে, এর আগে কখনও ইউরোপ-আমেরিকায় ইসরায়েল বিরোধী এমন বিক্ষোভ দেখা যায়নি। ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন এবারের ধরনই এই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।

এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় যে, এবারের ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ অভিযাত্রাও আগের পাঁচটির মতো শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনবাসী কী মেসেজ পেলো বা তাদের কী উপকার হলো? এক কথায় বলা যায়, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলো। এতে করে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হলো, ইউরোপের সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এলো, খোদ ইউরোপ-আমেরিকার ইহুদি জনগোষ্ঠীও ইসরায়েলি বর্বতা অতোটা মেনে নিতে পারছে না; এদিকে ইতালি বা গ্রিসের মতো দেশের সরকার বাধ্য হলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিতে, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মতো  দেশগুলোও বাধ্য হলো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে। এছাড়া তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা বা মালয়েশিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়াও ছিল উত্তাপ ছড়ানো। ইসরায়েল যেমন তার পুরোনো মিত্রদের হরাতে বসছে, তেমনি সর্বোপরী ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে নব উদ্দীপণায় এগিয়ে যাবে।  

উল্লেখ্য, ইসরাইলি বর্বরতায় গত দুই বছরে প্রায় ৭০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি সাধারণ নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে এবং প্রায় দুই লক্ষ মানুষ বিকলাঙ্গ হয়েছে। চারিদিকে শিশুর আর্ত্মনাদ, মায়ের কান্না আর আহাজারিতে মধ্যপ্রাচ্যের বাতাস এখন ভারী। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যে কোনো মানুষ এই এই পৈশ্বাচিক বর্বরতা মেনে নিতে পারে না। এবারের ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’র ব্যতিক্রমী আয়োজন ছিলো চোখে পড়ার মতো। ফ্রিডম ফ্লোটিলা’র সামরিক শক্তি নেই ঠিকই, তবে মানবিক শক্তিই যে ভবিষ্যৎ কোটি এটোম বোম্ব হয়ে দেখে দিবে; ইসরাইল তা কল্পনাও করতে পাবরে না। { লেখক : কবি ও নদী গবেষক}

 

Post a Comment

0 Comments

বৈশিষ্ট্যযুক্ত খবর

বগুড়ায় টিএমএসএসের উদ্যোগে শীতার্তদের মধ্যে কম্বল বিতরণ