ড. মো. মনছুর আলম
সুতিখালী নদী পাবনা জেলার একটি কাটা নদী। প্রাচীনকালে এর গতিপ্রকৃতি ইতিহাস-ঐতিহ্য ভিন্ন ছিল। সোনাতলা, সরিষা, ভিটেপাড়া দিয়ে প্রবাহিত ‘মর গাং’ নদীকে বর্ধিত করে চরপাড়া-সোনাকান্দর চিকনাই নদী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মূলত ভিটেপাড়া-সরিষা বড়ো ব্রিজের নিজ দিয়ে প্রবাহিত এবং-সোনাতলা বিলেল উত্তর প্রান্ত দিয়ে প্রাবাহিত প্রাচীন মর গাঙের পথ ধরে ১৯৮৯ সালে পাবনা পল্লি উন্নয়ন ও সেচ প্রকল্পের আওতায় পানি নিষ্কাষণ ক্যানেল হিসেবে সুতিখালী নদীর নবযাত্রা শুরু হয়। সূতিখালী বর্তমানে বেড়া, সাঁথিয়া ও ফরিদপুর উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত একটি রূপান্তরিত নদী।
নদীটির দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১২০ মিটার এবং গভিরতা ৪/৫মিটার। নদীর ধরন বা বৈশিষ্ট্য সর্পিল আকার, প্রকৃতি পাবনা পল্লি উন্নয়ন ও সেচ প্রকল্পের আওতায় পানি নিষ্কাষণ ক্যানেল। নদীর উৎস বেড়া পাম্পিং স্টেশনের পাশে হুরাসাগর নদী এবং পতিতস্থল সোনাকান্দর চিকনাই নদী।
সুতিখালী নদীর গতিপ্রকৃতি
সূতিখালী নদী পাবনা জেলার একটি ছোটো নদী হলেও এর প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে। বহু প্রাচীনকালে ‘মর গাং’ নদী অধীননগর হুরাসাগর নদী হতে উৎপত্তি হয়েছিল। সেই মর গাঙের পথ ধরে তৈরি করা সুতিখালী নদী বর্তমানে বেড়া-বৃশালিখা পাম্পিং স্টেসশনের পশ্চিম গা ঘেঁষে হুরাসাগর নদী থেকে উৎপত্তি। অপর একটি রুট রাখা হয়েছে বেড়া-বৃশালিখা পাম্পিং স্টেসশনের পানি নিষ্কাশনের পথ হিসেবে। সুতিখালী নদী উৎপত্তিস্থল হুরাসাগর স্লুইসগেট থেকে আমাইকোলার উত্তর-পশ্চিম পাশ দিয়ে অগ্রসর হয়ে সুতিখালী বিলের মধ্যদিয়ে অগ্রসর হয়ে ভিটেপাড়া মাঠ অতিক্রম করেছে। অতঃপর বামে মোড় নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে সরিষা-ভিটেপাড়া ব্রিজের নিচ দিয়ে অগ্রসর হয়ে সোনাতলা ক্ষুদে বিল অতিক্রম করেছে। অতঃপর সোনাতলা দীঘা বিল হয়ে ভোমরা বিল অতিক্রম করে চক মধুপুর, খিদিরগ্রামে গিয়ে পৌঁচ্ছে। খিদিরগ্রাম থেকে এঁকেবেঁকে অগ্রসর হয়ে কাশিয়াবাড়ি, রুদ্রগাঁতী অতিক্রম করে ধূলাউড়ির পাশ দিয়ে মনোহরপুর, লক্ষ্মীপুর অতিক্রম করে। অতঃপর লক্ষ্মীপুর থেকে সোজা পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে বিলচাপড়ি অতিক্রম করে চরপাড়া-সোনাকান্দর গিয়ে চিকনাই নদীতে নিপতিত হয়েছে। পতিত স্থলে অর্থাৎ চরপাড়া-সোনাকান্দর ১৫ ভেন্টের একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে পনিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
সুতিখালী নামকরণ
‘সুতিখালী নদী’ নামে একক কোনো নদীর নাম এই অঞ্চলে ছিল না। সুতিখালী এই অঞ্চলের একটি বিলের নাম। এটি সাঁথিয়া উপজেলা ও বেড়া উজেলার সীমান্তবর্তী আমাইকোলা, ভিটেপাড়া এবং শাহজাদপুর উপজেলার চয়ড়া গ্রামসমূহের বিল। বিলটির পূর্বে আমাইকোলা, দক্ষিণে ভিটেপাড়া, পশ্চিমে পাটগাড়ি এবং উত্তরে চয়ড়া ও ‘মুজিব বাঁধ’ দ্বারা বেষ্টিত। সিএস মানচিত্রেও এই বিলের নাম সুতিখালী হিসেবে আছে। মূলত এই বিলের নাম হতে সুতিখালী নদীর নাম রাখা হয়েছে।
১৯৭২ সাল পরবর্তীতে বিলের মুখ বরাবর ‘মুজিব বাঁধ’ দেওয়া হলে ‘মর গাং’ নদীর উৎস; এমনকি পাশেই অধিননগর অপর একটি নদী ‘বলেশ্বর নদী’র পতিতস্থল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মর গাং নদী তার নিয়মিত উৎস হারায় এবং অনিয়মিত নদীতে পরিণত হয় এবং ধীরে ধীরে মরা নদীতে পরিণত হয়। পরে ১৯৯১-৯২ সালে পাবনা পল্লি উন্নয়ন ও সেচ প্রকল্পের আওতায় ‘মুজিব বাঁধ’ বরাবর ১২ পাল্লার বৃহৎ স্লুইসগেট নির্মাণ করে এর প্রাণ দেওয়া হয়। বর্ষার সময় স্লুইসগেটের পাল্লা খুলে দিলে হুরাসাগর নদীর পানি প্রচণ্ড বেগে মর গাং দিয়ে ঢুকে অত্র এলাকা প্লাবিত করতো; অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমেই শুধু হুরাসাগর হতে পানি পেতো।
প্রাচীনকালে বর্ষা মৌসুমে এই নদী পথে হুরাসাগর অধীননগর বাঁধ ভেঙে ঢোকা পানি, সুতিখালী বিলের পানি এবং ইছামতির পানি; এই সম্মিলিত পানির প্রচণ্ড স্রোতধারা বুকে ধারণ করে আমাইকোলা, ভিটেপাড়া, সোনাতলা, চক-মধুপুর, খিদিরগ্রামসহ অত্র এলাকার বিলসমূহে (ক্ষুদে বিল, দীঘা বিল, কাজলা বিল, ভোমরা বিল) ছেড়ে দিত। এই বিলসমূহ আবার উক্ত পানি বিভিন্ন জোলা-নালার মাধ্যমে ইছামতি নদীতে ঢেলে দিত। এভাবে দুই/তিন মাস পানি দেওয়া-নেওয়ার খেলা চলত। বর্ষা মৌসুমে মর গাঙের পানিতে সোনাতলা তলিয়ে যেত, তবে আশার কথা হলো পানির সাথে ব্যাপক পলিমাটি ও দেশি মাছের সমাগম ঘটতো। নদীর বক্ষে ছোটো বড়ো অনেক নৌকা চলাচল করত। লেখক বেড়া বি. বি. পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই নদী ব্যবহার করে অনেকবার সোনাতলা নানার বাড়ি এসেছেন। বর্তমানে নদীটি পাবনার একটি রূপান্তরিত ক্যানেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পাবনা ইছামতি নদী পুনরুজ্জীবিতকরণ মেগা প্রকল্পের ১১০ কিলোমিটার খনন/পুন:খনন কাজের আওতায় এই সুতিখালী চ্যানেলকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে; যা বর্তমানে খনন কাজ চলমান রয়েছে।
0 Comments