Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বড়াল নদীর গতিপ্রকৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য

 


ড. মো. মনছুর আলম

বড়াল পদ্মানদী প্রণালির অন্যতম একটি শাখানদী। নদীটি রাজশাাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বড়াল নদী রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলার গোপালপুর গ্রাম পদ্মা নদী হতে উৎপন্ন হয়ে উত্তর-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে বাঘা হয়ে নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম হয়ে চাটমোহর উপজেলার গোপালপুর গ্রাম দিয়ে পাবনা জেলায় প্রবেশ করেছে। চাটমোহর থেকে এঁকেবেঁকে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, সাঁথিয়া উপজেলার কিছু গ্রাম অতিক্রম করে সিরাজগঞ্জ জেলার বাঘাবড়ি হয়ে ‘ঘিনারটেক’ গ্রামের ত্রিমোহনায় উত্তর থেকে আসা হুরাসাগর নদীতে নিপতিত হয়েছে।

এক সময়ের প্রমত্তা বড়াল নদী এখন নানা শৃঙ্খলে বন্দি। ১৯৮৫ সালে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড চারঘাটে নদীর উৎসমুখ শাসন করে ৩০ ফিট চওড়া একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে। এর প্রায় ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে নাটোরের আটঘড়ি নামক স্থানে নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে, পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ড মাত্র ৮ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার মথুরাপুর একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে এবং ভাঙ্গুড়া উপজেলার দহপাড়ায় আরও একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে। এভাবে অপরিকল্পিত পানি নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন বাধা তৈরির ফলে নদীটি ধীরে ধীরে পানিশূন্য হয়ে তার পূর্বের জৌলুস হারিয়ে ফেলে। চারঘাট স্লুইসগেট স্থাপনের পূর্বে বড়াল নদী দিয়ে ২০ হাজার কিউসেক পনি প্রবাহিত হতো। ১৫ হাজার কিউসেক মেরে দিয়ে তিন ভেন্টের একটি স্লুইসগেট স্থাপন করা হলেও বাকি ৫ হাজার কিউসেক পানি ছাড়া তো দূরে থাক এই স্লুইসগেটর পাল্লা কখনও খোলা হতো না। অর্থাৎ ৫ হাজার কিউসেক পানি কেন কোনও পানিই এই পথে পাস করানো হতো না। ফলে ১ বছরের মধ্যে বড়াল অচল হয়ে পড়ে। এছাড়া নদীর বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পাবনা জেলার চাটমোহরে ৪টি আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ, অপরিকল্পিত ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, মাছের ঘের নির্মাণ, দখল-দূষণ করে নদীর স্বাভাবিক গতি রোধ করা হয়েছে। ফলে ১৯৮৫ সালের পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩১ বছরে বড়াল নদী দখল-দূষণে, ছোটো ছোটো পুকুরে এবং ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে পড়ে। ২০১৬ সালের পর থেকে কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে; এর মূল কারণ ‘বড়াল নদী রক্ষা আন্দোলনে’র কর্মতৎপরতা। পাবনা চাটমোহর থেকে ২০০৮ সালে এই বড়াল রক্ষা আন্দোলন শুরু হয়। তারা বিভিন্ন সভা-সেমিনার, মানববন্ধন, লিফলেট বিতরণ, গণসাক্ষর, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে বড়াল নদীর পক্ষে ব্যাপক জনসচেতনা তৈরি করতে সক্ষম হয়। তাতের এই দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল ফলতে শুরু করেছে বলে মনে হয়। এরই ফলশ্রুতিতে বর্তমান সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রনণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গত ১৯ মে রাজশাহীর চারঘাট স্লুইসগেট পরিদর্শন করেন এবং নাটরের আটঘড়ি এলাকায় বড়াল নদীর উপর নির্মিত ৫ ভেন্টের স্লুইসগেট এলাকা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শ শেষে তিনি বলেন, বড়াল নদীকে বাঁচাতে চাই। বড়ালের প্রাণ ফেরাতে একটা একটা পরিকল্পণা প্রণয়ন করাই আছে। চারঘাটের স্লুইসগেট তুলে দিয়ে খনন কাজ বাস্তবায়ন আমাদের প্রথম পরিকল্পনা। দ্বিতীয় দফায় আমরা আরো একটা পরিকল্পনার রূপরেখা অনুমোদন দিয়ে যেতে চাই। তিনি আরো বলেন, বড়ালসহ দেশের সকল নদীকে চলমান রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এজন্য দীঘমেয়াদী পরিকল্পনার রূপখো গ্রহণ করে দিয়ে যেতে চাই। সে ধারায় বড়াল নদীর পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে সরকার সমন্বিত পদক্ষেপ নেয় এবং পরবর্তিতে ১২ জুন পানি উন্নয়ন বোর্ড চিরদিনের জন্য চারঘাট স্লুইসগেটের কপাট তুলে নিয়ে যায়। ফলে দীর্ঘ ৪০ বছর পর দুরন্ত, যৌবনা স্রোতস্বিনী বড়াল নদী দেখলো তীরের চার জেলার জনগণ। মূলত দীর্ঘ বছর পানিপ্রবাহ না থাকায় বড়াল নদী মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। বড়াল নদীর পানি হ্রাস এবং বড়াল, চলনবিলের পানি প্রবাহের প্রধান উৎস হওয়ায় নদী বিশেষজ্ঞগণ এবং পরিবেশবিদ এবং আমরা নদী কর্মীদের চিন্তার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দাবী এই ২২০ কিলোমির নদী একক বা একীভূত নদী দেখতে চাই। নাটোরের আটঘড়ি থেকে বনপাড়া পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার নদী উদ্ধার চাই। বড়াল নদীর এই অংশ দখল করে গড়ে উঠেছে বাগ-বাগিচা, ঘরবাড়ি, দালানকোঠা, সরকারি তহশীল অফিস, গুচ্ছগ্রাম ইত্যাদি।    

বড়াল নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২২০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ প্রায় ১৪০ মিটার; বড়াল নদীর পাবনা অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৩ কিলোমিটার এবং নদীর গভীরতা ৫ মিটার। নদীর ধরন বা বৈশিষ্ট্য সর্পিল আকার এবং প্রকৃতি মৌসুমি প্রকৃতির। নদীর অববাহিকা অঞ্চল ৭৭০ বর্গকিলোমিটার। বড়াল নদী উৎস চারঘাট থেকে মিলিত স্থান হুরাসাগর পর্যন্ত দীর্ঘ প্রবাহপথে মোট ১৯৩টি গ্রামকে স্পর্শ করেছে।  

বড়াল নদী মূলত চারটি জেলা নয় বলতে গেলে গোটা উত্তর জনপদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো গঠনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীন সাহিত্য, ধর্মগ্রন্থ ও ইতিহাস গ্রন্থে বড়াল নদীর ঐতিহ্যের কথা পাওয়া যায়। নদীটি উৎসস্থল চারঘাট গোপালপুর গ্রাম থেকে বের হয়ে পূর্বমুখী প্রায় সাত কিলোমিটার অগ্রসর হয়ে চাঁদনগর এসে পুরা এক সমকোণ বাঁক নিয়ে উত্তরমুখী হয়েছে। অতঃপর এখান থেকে বনকিশোর, পাটিয়াকান্দি, শিমুলিয়া, রুস্তমপুর হয়ে আড়ানি নৌবন্দর আতিক্রম করে হাঁপানিয়া নামক স্থানে পৌঁছে। বড়ালের এখানে তৈরি বা কাটা হয়েছিল শাখানদ ঐতিহাসিক ‘মুসা খান নদ’। বড়াল এখান থেকে জামনগর, বড়োবাঘা, বাঁশবাড়িয়া, তমালতলা হয়ে মালঞ্চি। এখান থেকে দয়ারামপুর কাদিরাবাদ সেনানিবাস হয়ে নন্দকূজা গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়েছে। নন্দকূজা গ্রামের শেষ প্রান্তের দক্ষিণ পাড় দিয়ে বাঁক নিয়ে বড়াল দক্ষিণমুখী হয়েছে। এইখানে বড়াল থেকে জন্ম নিয়েছে একটি বৃহৎ শাখানদী যার নাম ‘নন্দকূজা’। অতঃপর বড়াল এখান থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে ওয়ালিয়া, হাড়োয়া ও বনপাড়া পৌরশহর অতিক্রম করে মহিষাভাঙা এসে পৌঁছে। বনপাড়া বড়াইগ্রাম উপজেলাধীন একটি পৌরশহর। ১২৬ বছর পূর্বে বড়ালের মূলস্রোত ভিন্ন পথে প্রবাহিত হবার কারণে বড়াল নদীর মূলস্রোত স্রোত একসময় এসে সংকুচিত হতে থাকে। এভাবে সংকুচিত হতে হতে বড়াল নদীর এই অংশ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে এসেছে। আটঘড়ি (নাটোর) থেকে বনপাড়া পর্যন্ত মূল বড়ালের প্রায় অধিকাংশই নদীদস্যূদের দ্বারা বেদখল হয়ে গেছে। বনপাড়া ১৫০ মিটার প্রশস্ত বড়াল নদী শাসন করে নদীর উপর মাত্র ৩০ ফিট প্রশস্ততার একটি ছোটো কালভার্ট (পাবনা-রাজশাহী মহাসড়কের উপর) তৈরি করা হয়েছে; যা নদীকে মেরে ফেলার পূর্ণ আয়োজন বলে মনে করা হয়। বনপাড়া বাজার অতিক্রম করে বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের উপর নির্মিত ছোটো একটি কালভার্টের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বড়াল মহিষাভাঙা গ্রাম অতিক্রম করেছে। অতঃপর মহিষাভাঙা হতে বড়াল নদী কয়েকটি গ্রাম ও ছোটো-বড়ো কয়েকটি বিল পারি দিয়ে জোয়াড়ি গ্রামের শেষ প্রান্তে নির্মিত ছোটো একটি ব্রিজ আতিক্রম করে তিরাইল ও কেল্লা গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়েছে। অতঃপর বড়াল তিরাইল ও কেল্লা অতিক্রম করে মুক্তনগর (প্রাচীন লেংটাদহ), মৌখরা বাজার, আগ্রান বুড়িগাঁও বা বড়াই গ্রাম, লক্ষ্মীকোল পৌরশহর, রয়না, রোলভা, বাগডোবা, চরগোবিন্দপুর হয়ে জোনাইল নামক নৌবন্দরে এসে পৌঁছে। অতঃপর জোনাইল থেকে পূর্বদিকে আরও সাত কিলোমিটার অতিক্রম করে পাবনার গোপালপুর-সোন্দভা গ্রামের মধ্য দিয়ে পাবনা জেলায় প্রবেশ করেছে। পাবনার তেবাড়িয়া গ্রাম অতিক্রম করে চাটমোহর উপজেলার ইতিহাস খ্যাত হরিপুর গ্রামে প্রবেশ করে। হরিপুর স্থানটি চলনবিল ও বিল কুরুলিয়ার মাঝখানে অবস্থিত; বিলকুরুলিয়া প্রাচীনকালে বড়াল-আত্রাই নদীর সঙ্গমস্থল ছিল। হরিপুর থেকে বড়াল চাটমোহর পৌর সদরের দিকে আরও সাত কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ধূলাউড়ি, রামনগর, ধুবইল, সোয়াইল, দোলং, বোথর অতিক্রম করে। বড়াল নদীর এই অংশে নদীর বুক বরাবর আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নদীকে পুকুর বা জলাশয়ে পরিণত করা হয়েছিল। বড়াল নদী রক্ষা আন্দোলনকারীদের লাগাতার আন্দোলন, রিভারাইন পিপল, বেলা, বাপা’সহ বিভিন্ন নদী ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর আন্দোলন ও তৎপরতার ফলে ২০১৬ সালে বাঁধগুলো অপসারিত হয়ে বর্তমানে সেখানে বড়ো বড়ো ব্রিজ সোভা পাচ্ছে। অতঃপর বড়াল চাটমোহর পৌরশহর ছেড়ে শালিখা হয়ে এঁকেবেঁকে নূরনগরে এসে পৌঁছেছে। নূরনগরে বড়ালের সাথে যুক্ত হয়েছে নন্দকূজা ও আত্রাই নদীর সম্মিলিত স্রোতধারা গুমানী নদী। গুমানী ও বড়াল নদীর এই সম্মিলিত স্রোতধারা বড়ালের সাথে একীভূত হয়ে বড়াল নামে আরও অগ্রসর হয়ে ভাঙ্গুড়া নৌবন্দরে এসে পৌঁচ্ছায়। অতঃপর ভাঙ্গুড়া থেকে এঁকেবেঁকে অগ্রসর হয়ে ফরিদপুর পৌর এলাকা, প্রাচীন গোপালনগর গ্রাম, নারায়ণপুর, দিঘুলিয়া, ডেমরা, সিলন্দা হয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ি নৌবন্দরে এসে পৌঁচ্ছায়। বাঘাবাড়ি থেকে আরও পূর্বদিকে প্রায় এক কিলোমিটার অগ্রসর হয়ে শ্যালাচাপড়ির ওখানে উত্তরদিক থেকে আসা প্রাচীন করতোয়া নদীর স্রোতধারা বুকে ধারণ করে অগ্রসর হয়। এভাবে পূর্বদিকে প্রায় চার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ঘিনারটেক নামক গ্রামের পাশে উত্তর দিক থেকে আসা প্রাচীন হুরাসাগর নদীতে নিপতিত হয়েছে। 

Post a Comment

0 Comments

বৈশিষ্ট্যযুক্ত খবর

বগুড়ায় টিএমএসএসের উদ্যোগে শীতার্তদের মধ্যে কম্বল বিতরণ