ওয়ান মিনিট টিভি ডেক্স :
৮৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পাবনা ইছামতি নদীর বেড়া বনগ্রাম-বৃশালিখা অংশের দৈর্ঘ্য মাত্র ১.৭৪ কিলোমিটার। আমরা জানি, ইছামতি নদীর উৎস পদ্মা ভাঁড়ারা থেকে আতাইকুলা-জগনাথপুর পর্যন্ত ৪০ কিমি এবং জগনাথপুর থেকে বেড়া পাম্পিং স্টেশন ৪২.২৬ কিমি; পাম্পিং স্টেশন আড়াঅড়ি বাঁধ থেকে বেড়া থানার পাশে হুরাসাগর নদীতে পতিতস্থান পর্যন্ত ১.৭৪ কিমি; অর্থাৎ সবমিলে দৈর্ঘ্য ৮৪ কিলোমিটার। এই ৮৪ কিমি নদীর ভাঁড়ারা থেকে জগনাথপুর পর্যন্ত ৪০ কিমি নদী বর্তমানে ইছামতি নদী পুনরুজ্জীবিতকরণ মেগা প্রকল্পের আওতায় খনন কাজ চলছে। বাঁকি জগনাথপুর থেকে বেড়া পাম্পিং স্টেশন ৪২.২৬ কিমি নদী পাবনা সেচ ও পল্লি উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন বড় ক্যানেল বা ‘প্রধান সেচ খাল’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অপর অংশ অর্থাৎ বেড়া পাম্পিং স্টেশন আড়াঅড়ি বাঁধ থেকে বেড়া থানার পাশে হুরাসাগর নদীতে পতিতস্থান পর্যন্ত ১.৭৪ কিমি নদী শৃঙ্খলে বন্দি করা হয়েছে। নদীর বুক বরাবর কয়েকটি আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নদীকে পুকরে পরিণত করা হয়েছে।
আজ আপনাদের সামনে ইছামতি নদীর এই অংশের অর্থাৎ বেড়া বনগ্রাম-বৃশালিখা অংশের বর্তমান অবস্থা ও করণীয় কথা বা ভবিষ্যৎ করণীয় কী? সেই বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।
বেড়া পাম্পিং স্টেশন আড়াআড়ি বাঁধ থেকে পতিতস্থল হুরাসাগর নদীর মুজিব বাঁধ পর্যন্ত এই পৌনে দুই কিলোমিটার নদীকে এখন নদী বললে ভুল হবে। কারণ এই সামান্য নদী অংশটুকুর মধ্যে বৃহৎ ও প্রসস্থ বাঁধ পড়েছে মোট ০৩টি। যেমন- ০১. বেড়া পাম্পিং স্টেশনের পূর্ব পাশে আড়াআড়ি বাঁধ, ০২. বেড়া বাজার-বৃশালিখা অর্থাৎ সাবেক ডেপুটি স্পিকারের বাড়ির পাশ দিয়ে আড়াআড়ি বাঁধ এবং ০৩. পতিত মুখ বরাবর বাঁধ বা মুজিব বাঁধ। এসব বাঁধ এখন জনচলাচলের ব্যস্ততম পাকা রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে; যা ইছামতির এই অংশকে দ্বিখণ্ডিত করেছে।
মূলত ১৯৯২ সালে যখন বেড়া পাম্পিং স্টেশন চালু হয়; তারও কয়েক বছর পূর্ব থেকে এখানে নদীর বুক বরাবর আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়া শুরু হয়। এছাড়া ১৯৭২ সাল পরবর্তীতে ইছামতির পতিত মুখ বরাবর মুজিব বাঁধ পড়লে তখন থেকেই মূলত ইছামতি নদী মরতে শুরু করে। পরবর্তীতে পতিত মুখে ২ ভেন্টের ছোট্ট একটি স্লুইসগেট করলেরও নদীকে আর রক্ষা করা যায়নি। নদীর এই সামান্য অংশের উপর এতোগুলো পরিকল্পিত আঘাত; খণ্ড-বিখণ্ড করার ফলে নদী মজা নদী বা বদ্ধ পুকুরে পরিণত হয়। সুযোগ বুঝে বেড়া পৌর প্রশাসন পুকুর হিসেবে প্রভাবশালীদের কাছে বছর ওয়ারি ইজারা দিতে শুরু করে। ২০১৩ সালের দিকে পৌর প্রশাসন আবার এইটুকু নদীর বুক বরাবর আপর একটি বাঁধ দিয়ে পাকাকরণ করে সাবেক ডেপুটি স্পিকারের বাড়ির জন্য রাজপথ তৈরি করে দেয়। ২০২৪ সালে সাবেক ডেপুটি স্পিকার পুত্র এ্যাড. আশিফ শাম্স রঞ্জন তাদের বৃশালিখা বাড়ির সামনে নদী দখল করে সুইমিংপুল করার পরিকল্পনা হাতে নেন; এজন্য নদীর কিছু অংশ ভরাটও করা হয়। ইছামতি নদীর এই ১.৭৪ কিমি অংশ সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, নদীর প্রথম খণ্ড পাম্পিং স্টেশন থেকে সাবেক ডেপুটি স্পিকার এ্যাড. শামসুল হক টুকুর বাড়ি পর্যন্ত একটি পুকুরে পরিণত হয়েছে। এ অংশ কুচুরিপানা মুক্ত হলেও বদ্ধ পানির কারণে পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে; এছাড়া গোসলের পর চুলকানি ও ত্বকের প্রদাহজনিত নানা সমস্যাতো আছেই। নদীর উত্তর পাশে টুকু সাহেবের বাড়ির সম্মুখে মাটি ফেলে নদী ভরাট করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ টুকু সাহেবের বাড়ি থেকে মুজিব বাঁধের স্লুইসগেট পর্যন্ত নদী সম্পর্ণরূপে কচুরিপানায় পরিপূর্ণ রয়েছে। নদীর শেষ প্রান্তে মুজিব বাঁধে হুরাসাগরের সাথে একটি দুই ভেন্টের স্লুইসগেট লক্ষ্য করা গেছে। স্লুইসগেটটি তৈরির পর থেকে এর পাল্লাগুলো আদৌ খোলা হয় বা হয়েছিল কিনা তা বোধগম্য নয়।
করণীয় কথা:
# আমরা নদী ও পরিবেশকর্মীরা ইছামতি নদীর ৮৪ কিলোমিটার অংশ এক এবং অভীন্ন নদী হিসেবে দেখতে চাই।
ইছামতি নদীর উপর কোনো আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়া চলবে না। প্রয়োজনে লাগসই, যুৎসই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে নদীর প্রবাহ এবং নেভিগেশন ঠিক রেখে প্রযুক্তিগত পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।
# নদীর পতিতস্থলে বা উৎপত্তি স্থলে কোনো প্রকার বাধা বা স্লুইগেট তৈরি করে নদী প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করা যাবে না; করলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
# নদী প্রস্থ ঠিক রেখে নভিগেশনের কথা মাথায় রেখে উন্নত প্রযুক্তির ব্রিজগুলো তৈরি করতে হবে।
# বেড়া পাম্পিং স্টেশনের পূর্বপাশ দিয়ে নির্মিত নেভিগেশন লক চিরদিনের জন্য ভেঙে দিতে হবে, ব্রিজ ভেঙে দিয়ে সেখানে স্থায়ী বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ এই নেভিগেশন লক ৩৬ বছর পূর্বে তৈরি করা হলেও এই পথ দিয়ে জাহাজ তো দূরে থাক; বছরে একটি নৌকা পারাপার হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে।
# বেড়া পাম্পিং স্টেশনে পাশে আড়াআড়ি বাঁধ ভেঙে দিয়ে ইংল্যান্ডের টেমস নদীর ব্রিজের মতো উন্নত প্রযুক্তির/নেভিগেশন সুবিধা/একসাথে গাড়ি ও স্টিমার-নৌ চলাচল সুবিধা/লোকজ জ্ঞান মাথায় রেখে ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। এতে ইছামতি নদী কেন্দ্রিক/ব্রিজ কেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটবে।
# টুকু সাহেবের বাড়ির পাশে আড়াআড়ি বাঁধ এবং ইছামতির পতিতস্থল মুজিব বাঁধে একটি করে উন্নত প্রযুক্তির/নেভিগেশন সুবিধা/লোকজ জ্ঞান মাথায় রেখে ব্রিজ করতে হবে। এবং ইছামতি নদীকে হুরাসাগরের সাথে অবাধ/খোলামেলা পানি প্রবাহ ধরে রাখতে হবে। এতে বেড়া বনগ্রাম বাজার আরো সমৃদ্ধ হবে ও নৌবাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে এ কথা নিশ্চিত বলা যায়।
# নদীর দুইপারে লোকোজ জ্ঞান মাথায় রেখে বনায়ন করা যেতে পারে, বসার জন্য ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
# নদীর দুই পাড় গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করে, পায়ে হাঁটা-চলাচলের রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
0 Comments